খাদ্য ও ব্যাধিঃ জীবনচরিত ১

খাদ্য ও ব্যাধিঃ জীবনচরিত ১


"কিরে, তোকে এত রোগা লাগছে কেন, খাওয়াদাওয়া করিস না ?"

বান্ধবীর প্রশ্ন শুনে একটু থমকে যায় সাদিয়া। 

হালকা স্বরে উত্তর দেয় "ওজন বেড়ে যাবে।" 

এই চিন্তাটি সবসময়ই সাদিয়া কে আচ্ছন্ন করে রাখে। বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে বের হলে, বা কোনো একটি অনুষ্ঠানে খাওয়ার পর্ব আসার পর বারবার একটি কথা তার মাথায় আসতো, "সর্বনাশ! বেশি ওজন বেড়ে যাবে না তো আবার? 

বেশি ওজন বেড়ে গেলে নিজেকে দেখতে খুব খারাপ লাগবে।"

এই চিন্তার কারণে ভালো করে খাওয়াও হতো না। শুধু কি এটাই? সারাদিন কত রুটিন, কত কষ্টের, কত আত্মত্যাগের ফলে আজ সে তার ওজন কম রাখতে পেরেছে। তার প্রতিদিনের কষ্ট সার্থক। ছোটবেলা থেকেই খাবার থেকে দূরে থাকার প্রচেষ্টা সাদিয়ার, প্রতিদিন ১৫-২০ বার সে আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করে। বারবার তার মধ্যে একধরনের উদ্বেগ কাজ করে, যদিও সে কাউকে বলে না এটা। বললেই কি ভাববে কে জানে। তার বারবার মনে হয় যে "এই বুঝি ওজন বেড়ে গেলো"।

অথচ বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী অনেকের তুলনায় তার ওজন অনেক কম। ক্যাম্পাসে ক্লাস করতে যাওয়ার সময় সাদিয়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করতো, তাদের ওজন এর সাথে নিজেকে মিলিয়ে দেখতো। বোঝার চেষ্টা করতো যে ওজন বেড়ে যাচ্ছে কিনা। টিভিতে শারীরিক ভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখে বোঝার চেষ্টা করতো যে ওজন এরকম হওয়া দরকার। কতবার সাদিয়ার মা এবং সাদিয়া ঝগড়া করেছে খাবার নিয়ে তার কোনো হিসেব নেই। ওজন কোনোভাবেই যাতে না বেড়ে যায়। প্রতিদিন ওজন মেপে মার্ক করে রাখতো, বোঝার চেষ্টা করতো যে ওজন বেড়ে যাচ্ছে কিনা। 



হঠাৎ করে খারাপ ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে সাদিয়া। প্রায়ই নিজেকে অনেক ক্লান্ত লাগতো, সে বেশিক্ষন মনোযোগ দিয়ে কোন কাজ করতে পারতো না, খুব দ্রুত রেগে যেত, তার মেজাজ সারাক্ষণ খিটমিটে হয়ে থাকতো। এত গ্ল্যামার সচেতন থাকার পরেও তার স্কিন দিনকে দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সাদিয়ার কাছের বন্ধুরা প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায় এবং অনেক কিছু খায়, কিন্তু ওদের সাথে মিশলে এবং ঘুরতে গেলে তাকেও খেতে হবে বলে সে বন্ধুদেরও মাঝে মাঝে অ্যাভোয়েড করে।আবার মাঝে মাঝে গেলেও সে ভারি খাবার খায় না এটাও দৃষ্টিকটু লাগে।নিজেকে অসামাজিক মনে হয়। এসবের কারনে বন্ধুদের সাথেও তার দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে। সাদিয়ার আজকাল নিজেকে বড্ড একা লাগে। মনে হয় সে কোন কিছুর সাথেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। পরীক্ষার সময় সে বেশিক্ষণ মনোযোগ রাখতে পারছিলো না।ফলে নিজের উপরে রাগ হচ্ছিলো তার। এভাবে তার রেজাল্টও খারাপ হয়ে যায়। সাদিয়া তখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরে। এভাবেই চলতে চলতে হঠাৎ একদিন পরীক্ষার সময় সে মাথা ঘুরে পরে যায়। এরপর এ সমস্যাগুলোর জন্য তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোন ভালো ফলাফল পাওয়া যায় নি। একপর্যায়ে  ডাক্তার বলেন আপনার চিকিৎসা আসলে আমার কাছে নয়। অবাক সাদিয়া জিজ্ঞেস করে তাহলে আমি কার কাছে যাবো? ডাক্তার তাকে তার পরিচিত একজন সাইকোলজিস্ট এর কাছে পাঠালেন। সাদিয়া বুঝতে পারছে না যে সাইকোলজিস্ট এর কাছে সে কেন যাবে। যদিও মা বাবার কথা শুনে সে দেখা করতে গেলো সাইকোলজিস্ট এর কাছে। সাইকোলজিস্ট আপু তাকে প্রথম প্রশ্ন করলেন " আপনার কি এমন ভয় আছে যে খাবার খেলেই আপনার ওজন অনেক বেশি বেড়ে যাবে?" অবাক সাদিয়া উত্তর দিলো "জ্বী আপু, ওজন বেড়ে গেলে ভালো লাগবে না, আমার এই ভয় অনেক বেশি যে আমার ওজন বেড়ে যাবে"। তারপর সাদিয়া সাইকোলজিস্ট আপুকে সব কথা খুলে বললো,তার উদ্বেগ, তার ভয়ের কথা। আপু তখন বললেন "আপনার শারীরিক অসুস্থতা আসলে আপনার এই চিন্তা থেকেই হচ্ছে। আপনি একধরনের ইটিং ডিসঅর্ডার বা খাওয়ার ব্যাধিতে ভুগছেন। এটি একধরনের মানসিক ব্যাধি৷ আপনি যে ব্যাধিতে আক্রান্ত তার নাম এনোরেক্সিয়া নারভোসা।" 

সাদিয়া একটু অবাক হলো, সে জানতো না যে খাওয়ার ব্যাধি বলে কিছু আছে। তার কাছে মনে হতো যে অনেক খাওয়ার পর ওজন অনেক বেড়ে যায় সেটাই খাওয়ার ব্যাধি। সাইকোলজিস্ট আপু বললেন " না, এটা ভুল ধারণা।  খাওয়ার ব্যাধির মধ্যে শুধু এই বিষয়টিই নয়, বরং আরো অনেক ব্যাধি রয়েছে। আমাদের দেশে এই বিষয়টি নিয়ে অনেক ভুল ও ভ্রান্ত ধারণা আছে। আপনি একটি কাজ করতে পারেন, পান্ডা সামনে "ইট টু বিট" নামে খাওয়ার ব্যাধি সংক্রান্ত কিছু জনসচেতনতামূলক অনলাইন সেশন আয়োজন করতে যাচ্ছে। ইটিং ডিসঅর্ডার এর খুটিনাটি এবং প্রতিকার সম্পর্কিত সব কিছু আলোচনা করা হবে একটি স্পেশালিস্ট প্যানেল দ্বারা। সেটাতে অংশগ্রহণ করবেন এবং খাওয়ার ব্যাধি সংক্রান্ত সকল তথ্য আপনি জানতে পারবেন।"

সাদিয়া আপুকে ধন্যবাদ জানালো এবং আপুর পরামর্শ এবং ভবিষ্যতে পান্ডার সেশন থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই ব্যাধি থেকে প্রতিকারের চেষ্টা করবে বলে চিন্তা করলো।

Comments

Post a Comment